আর আট-দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো সাধারণ পরিবেশেই বড় হয়েছেন পূজা। ছোটবেলায় জীবনের লক্ষ্য, ক্যারিয়ার, ভবিষ্যৎ— এসব বিষয়ে গভীর কোনো চিন্তা ছিল না। এক পর্যায়ে তিনি উপলব্ধি করেন, সফল হতে চাইলে আত্মপ্রত্যয়ী হতে হবে, খুঁজে পেতে হবে নিজের ভালোলাগার বিষয়। এর সঙ্গে প্রয়োজন সাহস, আত্মবিশ্বাস আর অন্যের জন্য কিছু করার বাসনা। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এই বাঙালি তরুণী উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন সে দেশেই। হাজার হাজার মাইল দূরে বসেও ভাবছেন দেশের তরুণদের নিয়ে। তরুণদের আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার বার্তা দেওয়ার মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
পূজার পুরো নাম চিত্রলেখা কর। বাবা চিত্তরঞ্জন কর সাংবাদিক। মা শিপ্রা রানি কর্মকার অবসরপ্রাপ্ত নার্সিং সুপারভাইজার। বাবা-মা ও এক ভাইকে নিয়ে চারজনের ছোট পরিবার। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় দারুণ মনোযোগী ছিলেন পূজা। তবে পড়াশোনার বিষয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবার মধ্যে এক প্রকার দ্বিধা বা উদাসীনতার বিষয়টি তাকে ভাবাতো। পূজা বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখবেন অনেকে আছে যারা পদার্থবিজ্ঞান পড়ছে, উদ্ভিদবিজ্ঞান পড়ছে, কেউ বা মার্কেটিং নিয়ে পড়াশোনা করছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না এই বিষয়গুলো পড়ার পর তা তার জীবনে কীভাবে কাজে লাগবে, আদৌ জীবনের লক্ষ্য কী। এর কারণ মূলত সচেতনতার অভাব। অনেকেই পারিপার্শ্বিক চাপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো একটি বিষয়ে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হয়, কিন্তু বিষয়টি তার কতটুকু ভালো লাগে, সে ব্যাপারে ভাবে না। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা প্রকট। আমি ভেবেছি তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন, কারণ সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলার মতো করে নিজেকে গড়তে হলে আগে নিজেকে জানতে হবে। এক্ষেত্রে ‘বোল্ড’ হওয়া খুব জরুরি।
এমনই ধারণা থেকে তরুণ ও নারীদের সাহস যোগাতে ও তাদের মাঝে ইতিবাচক বার্তা দিতেই পূজা গড়ে তুলেছেন ‘বোল্ড অ্যান্ড বিকামিং’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম। বিভিন্ন ধরনের কর্মশালা, ওয়েবিনার ও লেকচার সিরিজ আয়োজন করছে প্ল্যাটফর্মটি। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা ৫—লিঙ্গসমতা অর্জনে সোচ্চার হয়ে কাজ করছে ‘বোল্ড অ্যান্ড বিকামিং’। এসব কর্মশালার মূল উদ্দেশ্য হল- তরুণদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা, নেতৃত্ব গুণের বিকাশ ও আত্মনির্ভরতার পাশাপাশি আন্তঃযোগাযোগ বৃদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করা।
‘ও’ লেভেল ও ‘এ’ লেভেলে পড়ার সময় রেড ক্রিসেন্ট, টিআইবি, অক্সফাম ও জাগো ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন কার্যক্রমে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে জড়িত ছিলেন পূজা। পরে বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়ে সেখানকার আডেলফি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাউন্টিংয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জাতিসংঘের যুবসমাবেশে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দূত হিসেবে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান তিনি। এখন নিউ ইয়র্কের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির পাশাপাশি ‘বোল্ড অ্যান্ড বিকামিং’ নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটছে তাঁর। সম্প্রতি ‘আই অ্যাম বোল্ড অ্যান্ড বিকামিং’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছেন, যেখানে আত্মনির্ভরতার গল্প তুলে ধরা হয়েছে আঁকা ছবির মাধ্যমে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সহ ৫টি দেশ- আফগানিস্তান, ভারত, নেপাল ও নাইজেরিয়ার প্রায় ৩ হাজার তরুণ ও নারী ‘বোল্ড অ্যান্ড বিকামিং’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে বাংলাদেশের ১০০টিরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী রয়েছে। বিভিন্ন সেশনে অংশ নিয়েছেন অভিনয়শিল্পী বিপাশা হায়াত, ইরেশ জাকের, সঙ্গীতশিল্পী ফুয়াদ, শিতম, গণিতবিদ চমক হাসান প্রমুখ। বাংলাদেশে ইএমকে সেন্টার এই প্ল্যাটফর্মের আউটরিচ পার্টনার হিসেবে কাজ করছে। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের উপাচার্য ড. রুবানা হকও একটি সেশনে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।
পূজা বিশ্বাস করেন, জীবনে বড় হতে চাইলে কাউকে রোল-মডেল হিসেবে নির্ধারণ করা জরুরি। চারপাশে এমন অনেকেই আছেন যারা রোল-মডেল হতে পারেন। তাদের অনুসরণ করার মাধ্যমে সফল হওয়া সম্ভব। সাফল্যের স্পর্শ পেতে শুরু করেছেন পূজা নিজেও। আডেলফি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে নিয়ে দুটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে, যেখানে উঠে এসেছে পূজার গল্প, যে পূজা সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন।

